জামদানি শাড়ি ভালবাসেন না, এমন কেউই বোধহয় নেই।
ঢাকাই জামদানি শাড়ির জন্ম আজকের ওপার বাংলা বা বাংলাদেশে হলেও এপার বাংলাতেও তা সমান জনপ্রিয়।
কিন্তু জানেন কি এহেন জামদানি শাড়ির জন্ম কিভাবে হল বা কী তার ইতিহাস ?
জামদানি প্রাচীনকালে তাঁত বুনন প্রক্রিয়ায় কার্পাশ তুলার সুতা দিয়ে মসলিন নামে সূক্ষ্ম বস্ত্র তৈরি হতো এবং মসলিনের উপর যে জ্যামিতিক নকশাদার বা বুটিদার বস্ত্র বোনা হতো তারই নাম জামদানি।
জামদানি বলতে সাধারণত শাড়ি বোঝানো হলেও প্রকৃতপক্ষে ঐতিহ্যবাহী নকশায় সমৃদ্ধ ওড়না, কুর্তা, পাগড়ি, ঘাগরা, রুমাল, পর্দা, টেবিল ক্লথ সবই জামদানির আওতায় পড়ে।
সপ্তদশ শতাব্দীতে জামদানি নকশার কুর্তা ও শেরওয়ানির ব্যবহার ছিল।
মুগল আমলের শেষের দিকে নেপালে ব্যবহূত আঞ্চলিক পোশাক রাঙ্গা-র জন্য বিশেষ ধরনের জামদানি কাপড় তৈরি হতো।
জামদানির নামকরণ নিয়ে বিভিন্ন ধরনের মতবাদ রয়েছে।
একটি মত অনুসারে ‘জামদানি’ শব্দটি ফার্সি ভাষা থেকে এসেছে।
ফার্সি জামা অর্থ কাপড় এবং দানা অর্থ বুটি, সে অর্থে জামদানি অর্থ বুটিদার কাপড় ।
একারণে মনে করা হয় মুসলমানেরাই ভারত উপমহাদেশে জামদানির প্রচলন ও বিস্তার করেন।
আরেকটি মতে, ফারসিতে জাম অর্থ এক ধরনের উৎকৃষ্ট মদ এবং দানি অর্থ পেয়ালা ।
জাম পরিবেশনকারী ইরানী সাকীর পরনের মসলিন থেকে জামদানি নামের উৎপত্তি ঘটেছে।
উৎপত্তি ও বিকাশ বাংলায় বস্ত্রশিল্প এর প্রাচীনতম উল্লেখ পাওয়া যায় কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্রে (আনু. ৩০০ খ্রি),
চর্যাগীতির বিভিন্ন পঙ্ক্তি এবং প্লিনির রচনায়, খ্রিস্টীয় প্রথম দশকে রচিত পেরিপ্লাস অব দি এরিথ্রিয়ান সি গ্রন্থে এবং মার্কোপলো, ইবনে বতুতা, চীনা পরিব্রাজক ও ফরাসী রাষ্ট্রদূতের বর্ণনায়।
কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্রে বঙ্গ ও পুন্ড্র এলাকায় তৈরি সূক্ষ্ম বস্ত্রের উল্লেখ আছে। বঙ্গ ও পুন্ড্রতে চার প্রকার বস্ত্রের প্রচলন ছিল: ক্ষৌম, দুকূল, পত্রোর্ণ ও কার্পাসী।
জামদানির প্রকারভেদ জামদানি নকশার প্রধান বৈশিষ্ট্য এর জ্যামিতিক অলঙ্করণ।
জামদানি নকশা বর্তমানের মত কাগজে এঁকে নেওয়া হতো না।
দক্ষ কারিগর স্মৃতি থেকে কাপড়ে নকশা তুলতেন।
নকশা অনুযায়ী বিভিন্ন জামদানি বিভিন্ন নামে পরিচিত, যেমন পান্না হাজার, দুবলি জাল, বুটিদার, তেরছা, জালার, ডুরিয়া, চারকোণা, ময়ূর প্যাঁচ,
চন্দ্র পাড়, চন্দ্রহার, হংস, ঝুমকা, কাউয়ার ঠ্যাঙা পাড়, চালতা পাড়, ইঞ্চি পাড় ও বিলাই আড়াকুল নকশা, কচুপাতা পাড়, বাড়গাট পাড়, করলাপাড়,
গিলা পাড়, কলসফুল, মুরালি জাল, কচি পাড়, মিহিন পাড়, কাঁকড়া পাড়, শামুকবুটি, প্রজাপতি বুটি,
বেলপাতা পাড়, জবাফুল, বাদুড় পাখি পাড় ইত্যাদি। বর্তমানে শাড়ির জমিনে গোলাপফুল, জুঁইফুল, পদ্মফুল, কলারফানা, আদারফানা, সাবুদানা ইত্যাদি নকশা করা হয়।
সাম্প্রতিক সময়ে ঐতিহ্যবাহী জামদানি নকশাকে পুনরুজ্জীবিত করার প্রয়াস চলছে।
ছোট ছোট বিভিন্ন ফুলের বুটি তোলা জামদানি বুটিদার নামে পরিচিত।
জামদানি বস্ত্রে ছোট ছোট ফুলগুলি যদি তেরছাভাবে সারিবদ্ধ থাকে তাকে তেরছা জামদানি বলে।
এ নকশা শুধু যে ফুল দিয়েই হবে তা নয়, ময়ূর বা লতাপাতা দিয়েও হতে পারে।
ফুল, লতার বুটি জাল বুননের মতো সমস্ত জমিনে থাকলে তাকে জালার নকশা বলা হয়।
সারা জমিনে সারিবদ্ধ ফুলকাটা জামদানি ফুলওয়ার নামে পরিচিত।
ডুরিয়া জামদানি ডোরাকাটা নকশায় সমৃদ্ধ থাকে।
বেলওয়ারি নামে চাকচিক্যপূর্ণ সোনারুপার জরিতে জড়ানো জামদানি মুগল আমলে তৈরি হতো।
এ ধরনের জামদানি সাধারণত হেরেমের মহিলাদের জন্য বিশেষভাবে বোনা হতো।
জামদানির অতীত ও বর্তমান ব্যয়বহুল জামদানির উৎপাদন একচেটিয়াভাবে বহুকাল মুগলদের হাতেই ছিল।
ঢাকায় সদর মলমল খাস কুটির দারোগা জামদানি তৈরির জন্য তাঁতিদের দাদন দিয়ে জামদানি বুননে নিয়োগ করা হতো।
এভাবে উৎপাদিত জামদানির মূল্য অনেক বেশি হতো।
রাজন্য শ্রেণীর জন্য উচ্চমূল্যের জামদানি প্রস্ত্তত হতো রাজকীয় কারখানায়।
অভিজাত ধনীরাও নিজেদের ব্যবহার্য জামদানি প্রস্ত্ততের জন্য উচ্চমূল্যের কারিগর নিয়োগ করতেন।
বিশ্ববাজারেও এসব বহুমূল্য জামদানির ব্যাপক চাহিদা ছিল।
এশিয়া ও ইউরোপের রাজন্যবর্গ প্রায়শ ঢাকাই জামদানির জন্য বিভিন্ন বণিক কোম্পানিকে অর্ডার দিতেন।
কিন্তু উনিশ শতকের প্রথমদিক থেকে উচ্চমূল্যের জামদানি উৎপাদন ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হতে থাকে।
তখন স্বল্পদামের মিলের কাপড় বিশ্ববাজার দখল করে নেয়।
বহু বাধা অতিক্রম করে জামদানি একবিংশ শতাব্দীতে এসেও তাঁর ঐতিহ্য রক্ষা করে টিকে আছে।
বর্তমানে এর প্রধান সমস্যা, তাঁতশিল্পীরা সঠিক পারিশ্রমিক পান না।
একটি ভাল জামদানি শাড়ি তৈরি করতে তাদের এক থেকে দুই মাস সময় লেগে যায়।
সে তুলনায় তারা মজুরি পান খুব কম।
১৭৮৭ সালে জেমস ওয়াইজ এর মতে ৫০ লাখ এবং জেমস টেইলরের মতে ৩০ লাখ টাকার মসলিন ইংল্যান্ডে রপ্তানি করা হয়েছিল।
কিন্তু ১৮০৭ সালে এই পরিমাণ ৮.৫ লাখ টাকায় নেমে আসে এবং শেষ পর্যন্ত ১৮১৭ সালে রপ্তানি পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যায়।
পরবর্তীতে ব্যক্তিবিশেষের মাধ্যমেই কেবল ইউরোপে মসলিন পাওয়া যেত।
উনিশ শতকের মাঝামাঝি জামদানি ও মসলিনের এক হিসেব থেকে দেখা যায় সাদা জমিনে ফুল করা কাজের ৫০,০০০ টাকার জামদানি দিল্লী,
লক্ষ্মৌ নেপাল, মুর্শিদাবাদ প্রভৃতি এলাকার নবাবরা ব্যবহার করতেন।
এই শিল্প সংকুচিত এবং পরে বিলুপ্ত হওয়ার পেছনে কিছু কারণ ছিল, যার মধ্যে প্রধান কারণ ইংল্যান্ডের শিল্প বিপ্লব।
এর ফলে বস্ত্রশিল্পে যন্ত্রের আগমন ঘটে এবং কম মূল্যে ছাপার কাপড় উৎপাদন শুরু হয়।
এছাড়া দেশী সূতার চেয়ে তখন বিলেতি সূতার দাম কম ছিল।
তৎকালীন মোঘল সম্রাট ও তাদের রাজ কর্মচারীরা এ শিল্পের প্রতি অমনোযোগী হয়ে পড়েন।
ফলে ধীরে ধীরে মসলিন ও জামদানি শিল্প কালের গহ্বরে হারিয়ে যায়।
বাংলাদেশ স্বাধীনতা পাবার পরে ঢাকার ডেমরায় জামদানি পল্লীর তাঁতিদের আর্থিক সাহায্য দেয়া হয়।
তবে মেধা ও পারিশ্রমিকের অভাবের কারণে তাঁতীরা আর এ পেশায় আসতে চাইছেন না।
কিশোরগঞ্জের বাজিতপুর উপজেলার অচল তাঁতগুলো প্রাচীন গৌরবগাঁথার নীরব সাক্ষী হয়ে রয়েছে।
কিশোরগঞ্জের জঙ্গলবাড়িরও একই দশা। বর্তমানে ঢাকার মিরপুরে জামদানি পল্লী স্থাপিত হয়েছে।
বিভিন্ন অনুষ্ঠানে জামদানির চাহিদা এখনও রয়েছে।
বর্তমান বাজারে জামদানির উচ্চমূল্য ও বিপুল চাহিদার কারণে বাংলাদেশের এই শিল্পে নতুন গতি সঞ্চার হয়েছে।
জামদানির পুনরুজ্জীবনের পথে প্রধান অন্তরায় হলো দক্ষ ও আগ্রহী তাঁতশিল্পীর অভাব।
এই শ্রম নিবিড় হস্তশিল্পে উপযুক্ত মজুরি নিশ্চিত না করা গেলে তাঁতিরা আগ্রহী হবে না।
জামদানি শাড়ির আগের সব বিখ্যাত ও অবিস্মরণীয় নকশা ও বুননের অনেকগুলোই বর্তমানে বিলুপ্ত।
নবীন কারিগররা অধিকাংশ নকশা সম্পর্কে অবহিত নয়।
আদি জামদানির নকশা ও বুনন কৌশল নতুন প্রজন্মের কাছে স্থানান্তর একটি চ্যালেঞ্জ।
আমাদের সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে ভিজিট করুন www.shodagor.com .
আর shodagor.com এর হটলাইনে যোগাযোগ করতে পারেন 09678110033 .
সময় : প্রতিদিন সকাল ১০:০০ – বিকাল ০৭:০০ টা পর্যন্ত। (শুক্রবার বন্ধ থাকে)